এসো হে বৈশাখ…
এসো হে বৈশাখ…
বাঙালি মধ্যবিত্ত বাড়িতে নতুন বছর আসে নতুন জামার গন্ধে, বাংলা ক্যালেন্ডারের পাতায় আর খাবার পাতে। ইংরেজি বছরের শুরুতে সারা পৃথিবীর সঙ্গে বর্ষবরণে মাতলেও বছরের এই মাঝখানে একখানা নিজস্ব নতুন বছর শুরুর জন্য অপেক্ষা করে থাকে আপামর বাঙালি, সে ভৌগলিকভাবে যে যেখানেই থাকুক না কেন। বাংলার বারো মাসের তেরো পার্বণে চৈত্র সংক্রান্তি, গাজন, চরকের মেলা পার করে আসে নতুন বছর। ঠিক যেমন শীত পেরিয়ে রুক্ষ গাছে বসন্ত ফুল ফোটায়, রঙিন হয়ে ওঠে চারপাশ। বাংলায় পলাশ, মাধবীলতা, বিদেশের চেরি ব্লসম সব মিলিয়ে রঙের হুটোপুটি চলতে থাকে। প্রকৃতির রঙের সঙ্গেই মিলে যায় দোলের রঙ। আবীরের লালে পলাশের লাল মিশে যেতে যেতেই প্রকৃতি জানান দেয় যে ‘এবারের মত বসন্ত গত…”। তার মানেই গরমের আসা- যাওয়া, কালবৈশাখীর অনিমন্ত্রিতের বেশে হানা। বাংলা এখন যদিও আম্ফানের মতন ঝড় পেরিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে, কালবৈশাখী তার চেনা। গাছে আমের বোলের গন্ধ, কাঁচা আমের বাজার দখল সোচ্চারে নতুন বছরের কথা ঘোষণা করে।প্রকৃতির সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির বাড়িতে বাড়িতে চলে আরেক প্রস্তুতি। নতুন জামা কেনার পরব, চৈত্র সেল! কলকাতায় দোকানে দোকানে সেলের হাঁকের সমারোহ। হাতিবাগান, গড়িয়াহাটের ফুটপাথ ভরে ওঠে পসরায়, রাস্তায় তখন পা রাখা দায়। আগেকার দিনে শুনেছি, যখন আমাদের মতন সারাবছর ধরে জামা কেনার চল ছিল না, দুর্গাপুজো ছাড়া বছরের এই আরেকটি সময় ছিল, যখন বাড়ির সকলের কিছু না কিছু জুটত। এখনও সে কেনায় বিরাম ঘটে না। বিদেশি, প্রাইভেট কোম্পানিতে ছুটি না মিললেও নতুন জামা গায়েই আপিসকাছারি ছুটতে হয় কখনও। বাড়ি পরিষ্কার হয়ে সেজে ওঠে এই দিনকে ঘিরে। আর, যা ছাড়া বাঙালির উৎসব অচল, খাবার, তার কথা না বললে হয়! পয়লা বৈশাখের দিন ভোর থেকে আজও পাড়ার রেওয়াজি মাংসের দোকানের লম্বা লাইন বলে দেয়, বাঙালির খাবারের ট্রাডিশানে কোথাও ভাঁটা পড়েনি। বাড়িতে বাড়িতে রান্নার গন্ধ ম ম করে, আত্মীয়স্বজনে ভরে ওঠে সেদিন। বাড়ির বড়দের পায়ে প্রণাম করা এই দিনের রীতি। এইদিনের আরেক অন্যতম আকর্ষণীয় দিক হল হালখাতা। লাল কাপড়ে মোড়া এই খাতাকে পুজো করে গণেশ ঠাকুরের পায় ছুঁইয়ে ব্যবসার নতুন আর্থিক বছরের সূচনা হয়। এই দিন দোকানে দোকানে আসে নতুন ক্যালেণ্ডার, ফুল- আলোয় সেজে ওঠে দোকানঘর। সেখান থেকে নেমন্তন্ন যায় নিয়মিত ক্রেতাদের বাড়ি। বাবার হাত ধরে দোকানে দোকানে গিয়ে এই নেমন্তন্ন রক্ষার কথা বেশ মনে পড়ে। হাতে জমত ক্যালেণ্ডার আর মিষ্টির প্যাকেট। সেই লাল খাতায় দোকানি জমা করে সেদিনকার ব্যবসার হিসেব, বা যারা জমা থেকে শোধ দিচ্ছে। বছর শুরুর দিনের অর্থাগম সারাবছরের অর্থের জোগানকে সুনিশ্চিত করে- এমনটাই বিশ্বাস সকলের।দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে উৎসবের ধরণ বদলেছে। অনলাইনে কেনাকাটা কখনও চৈত্র সেলের ভিড় এড়াতে সাহায্য করে। বাড়িতে অত রান্না করার অবসর মেলে না এই ব্যস্ত জীবনের কুড়িয়ে পাওয়া ছুটির দিনে। তাই নানান হোটেল রেস্টুরেন্টে মেলে নববর্ষ স্পেশাল বাঙালি খাবারের আয়োজন। মোচার ঘণ্ট, লুচি, পটলের দোরমা থেকে চিংড়ি মালাইকারি সব পাত পেড়ে সাজিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত করে তারা। উৎসবের আমেজ যতটা সম্ভব চেটেপুটে নেওয়া যায় চারপাশ থেকে তার চেষ্টায় কোন খামতি নেও, কোথাও। উপহারে, আমেজে এই দিন এক নতুন বছরের গন্ধ মেখে আবার নতুন করে শুরু করে সব। আর নববর্ষ মানেই বারো মাসের তেরো পার্বণে আমুদে বাঙালির চোদ্দতম পার্বণ, পঁচিশে বৈশাখ, মানে রবীন্দ্রজয়ন্তীর প্রস্তুতি শুরু হয়। “হে নূতন, দেখা দিক আরবার, জন্মের প্রথম শুভক্ষণ…”
#BCAF #SubhoNoboborsho #BengaliNewYear